কর্তৃত্ব নয় ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে জনগণকে আপন করে নিতে হবে: রাষ্ট্রদূত মুশফিক

0
কর্তৃত্ব নয় ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে জনগণকে আপন করে নিতে হবে: রাষ্ট্রদূত মুশফিক

রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সেবা করার একটা সুযোগ উল্লেখ করে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেছেন,  কর্তৃত্ব নয় ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সেবা করার জন্য দেশের জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, নিতে হবে আপন করে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাবার পর যতই আপনি উন্নয়নের কথা বলেন, যদি মানসিকতার পরিবর্তন না হয়, তাহলে এই সংকটগুলো থেকেই যাবে, আমাদের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধবে। আমরা যে যেখানে আছি নিজের কাজটা ঠিকমত করে অন্তত অন্যের সমালোচনায় মুখর হই।

শনিবার সিলেট শহরে জেলা প্রশাসকের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘সিলেট বিভাগের বর্তমান শিক্ষা ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী এসব কথা বলেন। সিলেট জেলা প্রশাসন এবং জালালাবাদ অফিসার্স এসোসিয়েশন যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলমের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জালালাবাদ অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ডাক এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু নাসের খান।

রাষ্ট্রদূত মুশফিক তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন তাদের মনে রাখা উচিত ট্যাক্সের টাকায় আপনাদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত হয়, ভালো গাড়িতে চড়েন। এই জবাবদিহিতাটুকু থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা মনিবের আসনে নই, সেবকের দায়িত্বে।’

বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কর্তৃত্বপরায়ণতা যেনো আমাদের গ্রাস না করে, পারস্পরিক সমঝোতা এবং সম্মানের একটি পরিবেশ যেনো তৈরি হয়। এই জিনিসটা আমাদের সমাজে খুব অভাব। এক শ্রেণি মনে করে আমি উপরতলার মানুষ, আর অন‍্যজন মনে করে আমার জন্মই হয়েছে যেনো মানুষকে সালাম দেয়ার জন্য- এই ব্যবধান এবং দ্বিধার জায়গা ভেঙে দিতে হবে।’

সিলেটে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি নিয়ে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মুশফিক বলেন, বেশ কিছুদিন যাবৎ সিলেটের কিছু কিছু বঞ্চনার কথা শুনছিলাম দেশের বাইরে বসে। আমার কর্মস্থল এখন দেশের বাইরে। ঢাকার ফেরার পরই আমি এ বিষয় নিয়ে কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই এটার সমাধান নিয়ে চেষ্টা করছেন। যোগাযোগ উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়নে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। রেলে নতুন বগির অর্ডার করা হয়েছে। পাওয়া মাত্র সংযোগ করা হবে। বিমানের ভাড়া একটা নির্দিষ্ট হারের পর আর উঠবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে তারা স্থবির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। জনদুর্ভোগ লাঘবে টাকার যোগান দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তুত। 

পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সময়ের দুঃশাসন দেশের উন্নয়নে স্থবিরতা তৈরি করেছে উল্লেখ করে মুশফিক বলেন, ‘বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছরের একটা শাসনের অবসান ঘটেছে। এ ধরনের শাসনের পতনের পর যে পরিস্থিতির তৈরি হয় তাতে পুরো দেশকে একসঙ্গে সেবা দেওয়াটা সম্ভব হয়ে উঠে না, এ সমস্ত ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ঘটে, ছন্দপতন ঘটে। বিষয়টা এমন না যে, সিলেটের ন্যায্য দাবির প্রতি কেউ অবজ্ঞা করছে বা মনযোগ দিচ্ছে না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না। যথাযথ যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা উচিত।’

তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে একটা দীর্ঘ দিনের অভ্যাস হলো নিজের দায়িত্ব পালন না করে অপরের ওপর দোষ চাপাই, আমরা বলতে দেখি- উনি এটা করে নাই, সেটা করে নাই। সমাজে এবং রাষ্ট্রে এরকম দায় চাপানোর একটা অভ্যাস দেখা যায়। অথচ নিজেকে প্রশ্ন করতে চাই না, আমি আমার কাজটা সঠিকভাবে পালন করছি কী না?

সমাজের প্রথাগত বাধা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “এই সমাজের কিছু প্রথাগত বাধা রয়েছে যেগুলো অন্যরা  অনেক আগেই অতিক্রম করেছে কিন্তু আমরা এখনো সেখানে নিপতিত রয়েছি। আমরা যদি এটা অতিক্রম করতে না পারি, আমাদের মধ্যে যদি ভ্রাতৃত্ব যদি না গড়ে উঠে তাহলে পরিবর্তন হবেনা। সমাজ ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন দরকার।”

রাষ্ট্রের দায়িত্বকে সেবা করার সুযোগ হিসেবে দেখতে সরকারি কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, উদাহরণ হিসেবে বলি, আমাকে কেউ টার্গেট ঠিক করে দেয়নি। কিন্তু আমি নিজ থেকে মেক্সিকোসহ ল‍্যাটিন অ‍্যামেরিকায় কীভাবে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করছি।  সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করা সম্ভব।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. সৈয়দ মাসুম বলেন, সিলেট বিভাগে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো সুনামগঞ্জ জেলায় এই সংখ্যাটা ৩৪.২৪ শতাংশ। বন্যায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত বলেও জানান তিনি।

প্রবন্ধে বলা হয়, সিলেট বিভাগে গণিত, বিজ্ঞান এবং ইংরেজিতে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। আর এই ঘাটতির রেশ দেখা গেছে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে। সরকারি স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হচ্ছে ১: ১৮৫, অন্যদিক বেসরকারি স্কুলগুলোতে এটার অনুপাত আরও কম। হাওর এবং চা বাগানের এলাগুলােতে দরিদ্র লোকের বসবাস বেশি বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

জালালাবাদ অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, সিলেট এক সময় সারাদেশে শিক্ষার রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই অঞ্চলের বুদ্ধিভিত্তিক নেতৃত্ব কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উন্নতি ঘটাতে হলে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ এবং বিশ্লেষণী দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. জাবের, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আব্দুর রহমান তরফদার, জাতীয় বেতন কমিশনের সচিব ফরহাদ সিদ্দিকী এবং সিলেট বিভাগের কমিশনার খান মো. রেজাউন নবী প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here