কমেনি প্রশাসনে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের দাপট

0
কমেনি প্রশাসনে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের দাপট

প্রশাসনের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে প্রায় ১০ মাস আগে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ক্ষেত্রে বিসিএস ২০তম ব্যাচকে নিয়মিত হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই ব্যাচের পদোন্নতিযোগ্য প্রায় ৩০০ কর্মকর্তার চাকরিজীবনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে বৈঠক শুরু করে পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। এরই মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি এসএসবি।

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

সূত্র জানায়, এই ব্যাচের ৪৩ জন কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন জেলার ডিসি এবং ৪০ জন কর্মকর্তা মন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। তাঁদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী আমলের সূবিধাভোগী এসব ডিসি-পিএসরাই নানাভাবে পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন।

তাঁদের অনেকে এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে কর্মরত। তবে বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।

জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলের প্রথম দফায় ২০০১ সালে বিসিএস ২০তম ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। এই নিয়োগে অল্প কিছু মেধার ভিত্তিতে দিলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়োগের অভিযোগ ওঠে।

বিতর্কিতভাবে নিয়োগের পর গত ১৫ বছর প্রশাসন ক্যাডারকে দলীয়করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন এই ব্যাচের কর্মকর্তারা। এই ব্যাচের প্রভাবশালী কর্মকর্তারাই আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস) ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ৪৩ জন কর্মকর্তা ডিসি এবং ৪০ জন কর্মকর্তা মন্ত্রীদের পিএস ছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসায় এরই মধ্যে প্রশাসনের প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তাকে ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে।

ফলে এই ব্যাচের পদোন্নতির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০১৯ সালে যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেও তাঁদের পদোন্নতি হয়েছে ২০২১ সালে। যুগ্ম সচিব হিসেবে দুই বছর চাকরি করলেই অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জিত হয়। সেই হিসাবে ২০২৩ সালে তাঁরা অতিরিক্ত সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। অথচ অতিরিক্ত সচিবের স্বল্পতার জন্য অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগে পদায়ন করা যাচ্ছে না। একজন অতিরিক্ত সচিব দুই বা ততোধিক অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক সংস্থা ও করপোরেশনে চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী ও মহাপরিচালক পদ শূন্য থাকার পরও কর্মকর্তা স্বল্পতার কারণে পদায়ন করা যাচ্ছে না। অনেক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদায়ন করতে পারছে না সরকার। পদোন্নতির জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রত্যেক কর্মকর্তার কর্মজীবনের সব নথিপত্র, প্রয়োজনীয় নম্বর, চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা, দুর্নীতির বিষয়সহ সামগ্রিক বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যাঁরা বিগত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএস ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর পিএস-এপিএস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, মহাপরিচালক, ২০১৮ সালের নৈশ নির্বাচনে ডিসি হিসেবে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিভিন্নভাবে বিগত সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখিয়েছেন তাঁদের পদোন্নতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

পদোন্নতির জন্য গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে পাঁচটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের কোটায় নিয়োগ পাওয়া আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে এমপি-মন্ত্রীদের ম্যানেজ করে পদোন্নতি নিশ্চিত করা যাবে মনে করছেন। তাঁরা এরই মধ্যে সরকারের কয়েকজন সচিব, একাধিক উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি আটকে রেখেছেন বলে চাউর আছে। অভিযোগ উঠেছে, এই ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে এই পদোন্নতি আটকে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্যসচিব আবদুস সোবহান শিকদারের একজন সাবেক পিএস। তিনি অর্থসচিব ও এসএসবির একজন প্রভাবশালী সদস্যের মাধ্যমে পদোন্নতি আটকে দিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। যিনি এখনো অর্থবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের প্রধান। তাঁর সঙ্গে থেকে অর্থসচিবকে প্রভাবিত করছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া অর্থবিভাগের একজন যুগ্ম সচিব ও একই বিভাগে কর্মরত অন্য একজন যুগ্ম সচিব। যিনি দিল্লিতে ইকোনমিক মিনিস্টার হিসেবে পাঁচ বছর কাজ করা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশসংবলিত অডিও সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল।

এ ছাড়া এই তালিকায় আছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, যিনি রোহিঙ্গা সেলের দায়িত্বে আছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত থেকে আদানির চুক্তিসংক্রান্ত কাজে জড়িত থাকা এই কর্মকর্তা নিজ এলাকা চট্টগ্রামের একটি গ্রুপকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া একজন সিনিয়র সচিবকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনার সময়ের সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব। সূত্র আরো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে দাবি করা সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ারের ঘনিষ্ঠ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব।

সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here