এখনও কেন জুবিনের জন্য কাঁদছে আসাম?

0
এখনও কেন জুবিনের জন্য কাঁদছে আসাম?

আসামের জনজীবনে গভীর ছাপ রেখে যাওয়া শিল্পী জুবিন গার্গের মৃত্যু এক মাস পেরোলেও কমেনি শোকের আবহ। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় করছেন গুয়াহাটি শহরতলির কামারকুচিতে তাঁর চিতাস্থলে; যা এখন রীতিমতো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে এক দুর্ভাগ্যজনক ডাইভিং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫২ বছর বয়সী এই সংগীত আইকন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য।

চিতাস্থলে দেখা যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের অবিরাম সেবা, গামোছায় মোড়া স্মৃতিসৌধ, আর প্রার্থনাসঙ্গীতে ভেসে থাকা মানুষ। জায়গাটিতে কাঁদতে কাঁদতে অনেকেই গান ধরছেন, মায়াবিনী রাতির বুকত।

বিশ্বজুড়ে শ্রদ্ধার বন্যা বয়ে গেছে; দুবাই থেকে করাচি, সবাই স্মরণ করেছে তাঁর অবদান। গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে শহরে তাঁর মরদেহ আনার দিনে ১৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন, যা ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

আসামের মানুষের কাছে জুবিন গার্গ শুধু কণ্ঠশিল্পী ছিলেন না।
তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে খোলামেলা অবস্থান নিতেন, দানশীলতার জন্য ছিলেন সুপরিচিত, বন্যাদুর্গতদের জন্য ফুটবল খেলে অর্থ জোগাতেন, কোভিডের সময় নিজের বাড়ি খুলে দিয়েছিলেন আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে।

এক মুসলিম মাদ্রাসার এতিমদের জন্য গভীর রাতে ৭ লাখ রুপি দান করার ঘটনাটি এখনো মানুষের মুখে মুখে।

সিঙ্গাপুর পুলিশ মৃত্যুকে ‘অপমৃত্যু’ বললেও আসামের দাবি উঠেছে নিরাপত্তাজনিত গাফিলতি তদন্তের। এই ইস্যু ঘিরে রাজ্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। জুবিনের স্ত্রী গরিমা গার্গও তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

নব্বইয়ের দশকে সহিংসতা ও অস্থিরতার মধ্যে জুবিনের গান হয়ে উঠেছিল আশার সুর। তার নতুন ধারার সংগীত এবং দুঃসাহসিক সৃষ্টিশীলতা তরুণ সমাজকে নতুন পরিচয় দিয়েছিল।

অনেক শিল্পীই মনে করেন, জাতীয় মঞ্চে তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। কিন্তু আসামে তিনি রয়ে গেছেন কিংবদন্তি।
স্থানীয়রা বলেন, আসন্ন বিহু উৎসবে কুলি ডাকবে, কিন্তু জুবিনের গলা আর শোনা যাবে না, এই ভাবনাই বুক ভেঙে দিচ্ছে।

১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে জোরহাটের নির্জন রাতের রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে গান গাইতেন জুবিন। সেই অচেনা কিশোরের কণ্ঠই মাত্র তিন বছর পর হয়ে ওঠে অসমের আশা, স্বপ্ন আর পরিচয়ের প্রতীক।

টেলিভিশন সাংবাদিক নিপ কুমার বরুয়ার কথায়, আগামি রঙালি বিহুতে এক অচেনা শূন্যতা বয়ে আনবে। কুলি পাখির গান ঠিকই শোনা যাবে, কিন্তু জুবিনের সেই সোনালি কণ্ঠ বিহু মঞ্চে আর ফিরে আসবে না—এই ভাবনাই ভেঙে দেয় মন

সঙ্গীত বিশ্লেষক ভূঁইয়া জুবিনের প্রতিভার তুলনা করেছেন প্রখ্যাত সেতারবাদক রবি শঙ্করের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত জুবিন গানই শুরু করেননি, তখন শুধু বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, ঠিক যেমন রবি শঙ্কর তাঁর নৃত্য ক্যারিয়ার ছেড়ে ওই বয়সেই সেতার হাতে নেন। এ ধরনের মানুষরা জন্মগত প্রতিভা নিয়ে আসেন। 

দুবাই–ভিত্তিক গায়ক সুরজ বর্মার কথায়, বলিউডে তিনি অন্যরকম কণ্ঠের মালিক ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে, তাঁর মতো শিল্পীর বলিউডের প্ল্যাটফর্ম লাগেই না। তিনি তারও বহুদূর উপরে।

সুরজ জানান, জুবিনকে শেষ বিদায় দিতে হাজারো মানুষ যখন ‘মায়াবিনী’ গাইতে গাইতে কাঁদছিল, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়; আসামের সংস্কৃতিতে জুবিন গার্গ শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি একটি যুগ।

সূত্র: গালফ নিউজ 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here