ঋণ পুনঃ তফসিলে বাধা, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

0

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা, উচ্চ সুদের হার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একক গ্রাহক ঋণসীমার নতুন নিয়ম। পাশাপাশি গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একই সঙ্গে বাধা সৃষ্টি হয়েছে ঋণ পুনঃ তফসিলেও। নিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন। এতে বিপাকে পড়েছে দেশের বড় বড় গ্রুপ। শিল্প বাঁচাতে ও কর্মসংস্থানের চাকা সচল রাখতে ঋণ পুনঃ তফসিলের পরামর্শ উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকদের।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনিয়োগ কমার ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। আর তলানিতে ঠেকেছে শিল্পোৎপাদন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রায় তরুণদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাহিদার মধ্যে নানামুখী সংকটে জর্জরিত উদ্যোক্তারা। দেশের বড় বড় গ্রুপ বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।

এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই আমদানি-বিকল্প ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কর্মরত রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখ লাখ লোক, যাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজন। এমন ক্রান্তিকালে দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত হলেও উল্টো পদে পদে আসছে বাধা। দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংক খাতের এক-তৃতীয়াংশ ঋণ আদায় অনিশ্চিত বলে মত দিয়েছেন তাঁরা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছে কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো কম্পানি যদি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তাদের সুপারিশের মাধ্যমেই ব্যাংকগুলো ঋণ সুবিধা ও নীতি সুবিধার বিষয়ে বিবেচনা করতে পারে। গত ৩১ জানুয়ারি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন সময় যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পুনর্গঠনে নীতি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, বাছাইকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার সুপারিশ করা; যাতে তারা পুনর্গঠনের মাধ্যমে সচল ও লাভজনক হয়ে ওঠে, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ আদায়ও নিশ্চিত হয়। কিন্তু সেই কমিটি এখনো কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করেনি।

এই কমিটি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ৫০ কোটি এবং তার চেয়ে বড় অঙ্কের যেসব ঋণ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে শ্রেণীকৃত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সদয় বিবেচনা করে বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে। কিন্তু সেই কাজটিও এখনো শুরু হয়নি।

এদিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণ গণনা করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নিয়‌মে ঋণ তিন মাস প‌রি‌শোধ না করলে খেলাপি হিসেবে প‌রিণত হ‌বে। ঋণ মন্দ মান হলে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে। গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এসংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। নতুন নির্দেশনা ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল কার্যকর হবে।

নতুন নিয়মে ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করলেই সেই ঋণ খেলাপি হবে। আর মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে হলে নিম্ন, ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি হলে মন্দ ঋণ হবে। নিয়মিত ঋণের জন্য ১ শতাংশ এবং খেলাপির বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে নতুন নির্দেশনা কার্যকর হবে। তবে দেশের পরিস্থিতি ঠিক না হওয়ার আগে এমন সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আশঙ্কাজনক বলে মত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এককালীন পরিশোধ করে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে ঋণ নিয়মিত বিষয়ে ওই প্রজ্ঞাপনে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

উদ্যোক্তারা বলছেন, ডলার সাশ্রয়ে আমদানিতে কড়াকড়ি। সময়মতো এলসি করতে না পারা, জ্বালানির সংকটসহ নানা কারণে বহু কারখানার উৎপাদন নেমেছে শূন্যের কোঠায়। জ্বালানির সংকটে উৎপাদন ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বন্ধ ছিল। কারখানায় বিক্ষোভ, হামলা-মামলার কারণে ভারী শিল্প, পোশাক ও টেক্সটাইল খাত মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়েছে। বেসরকারি খাতের ডিসেম্বর মাসের বিনিয়োগ চিত্র দেখেই বোঝা যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রকৃত অবস্থা। ব্যবসার দৈনন্দিন খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে উদ্যোক্তাদের জন্য।

ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ। এর মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৯.৮ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে পৌঁছেছে। এসব মানুষের কর্মসংস্থান করতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলে মত বিশ্লেষকদের। এমন সময়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করে যেখানে উদ্যোক্তাদের পাশে থাকার কথা সেখানে এমন সব নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে, যার ফলে ঋণ খেলাপি হয়ে শিল্প-কারখানা বন্ধের উপক্রম হচ্ছে।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা ৩৫ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল বিগত সরকার। সেটা ২০২২ সালে। সেখানে ফান্ডেড ১৫ শতাংশ এবং নন-ফান্ডেড ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এখানে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, কিন্তু সেটা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে আমাদের পক্ষ থেকে সেটি ৩৫ শতাংশ রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’ সংকটের এই সময়ে ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার দাবি জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

২০২৩ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো খেলাপি গ্রাহককে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ঋণ দিতে পারবে না। তবে এই আইনের অন্য ধারায় বলা হয়েছে, পরস্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপভুক্ত কোনো খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত কারণ আছে, তাহলে একই গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান খেলাপি বলে গণ্য হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ঋণ দেওয়া যাবে। এর পর থেকে গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়ে আসছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর সেই বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা পালন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, একক গ্রাহক ঋণসীমা হবে মোট ২৫ শতাংশ। সেই প্রজ্ঞাপনে তখন বলা হয়েছিল, বর্তমানে একটি ব্যাংক ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে একজন গ্রাহককে মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এ সীমা পরিবর্তন করে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের বৃহৎ ঋণের পরিমাণও আগের চেয়ে কমানো হয়েছে। আগামী ১ এপ্রিল ২০২৫ থেকে এসব নির্দেশনা কার্যকর হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে নতুন করে ঋণ না নিয়েও আগের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অতিক্রম করেছে একক গ্রাহক ঋণসীমা। তাই ডলারের দাম বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুনরায় একজন গ্রাহককে মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পাওয়ার সুবিধা দেওয়া উচিত।

অর্থনীতিবিদ ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে কোনো কম্পানির একক গ্রাহক ঋণসীমা যদি অতিক্রম করে তাহলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সূত্র : কালের কণ্ঠ 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here