ইরানের চাবাহার বন্দর নিয়ে বিপাকে ভারত!

0

পারস্য উপসাগরের তীরের দেশ ইরানকে সাজা দিতে তৎপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিষেধাজ্ঞার জালে দেশটিকে জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন তিনি। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে ভারত। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে নয়াদিল্লি।

পশ্চিম এশিয়ার শিয়া মুলুক ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ‘আদায় কাঁচকলা’য়। যুক্তরাষ্ট্রের লাল চোখ উপেক্ষা করে লাগাতার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে তেহরান। এই ‘দুঃসাহসের’ সাজাও তারা পেয়েছে। ইরানের উপর বিপুল আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

পারস্য উপসাগরের দেশ ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় চাবাহার বন্দরটি নির্মাণ করেছে নয়াদিল্লি। এতে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেখানে কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতকে ছাড় দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন তা প্রত্যাহার করেছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।

এই ইস্যুতে ইতোমধ্যেই মুখ খুলেছে ওয়াশিংটন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ইরানের উপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করতেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে পশ্চিম এশিয়ার ওই শিয়া মুলুক, যা একেবারেই বরদাস্ত করতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র।

কৌশলগত দিক থেকে চাবাহার বন্দরের গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। এর সাহায্যেই মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য করে থাকে ভারত। চাবাহারের রাস্তায় আফগানিস্তান থেকে শুরু করে উজবেকিস্তান, এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি।

মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় পণ্য পৌঁছানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল পাকিস্তান। এশিয়া মাইনর ও ভারতের মাঝে অবস্থান হওয়ায় এই সুবিধা এত দিন ভোগ করে আসছিল ইসলামাবাদ। ফলে পণ্য পরিবহণের জন্য কতকটা বাধ্য হয়েই ইরানকে বেছে নেয় নয়াদিল্লি।

চাবাহার বন্দর নির্মাণের জেরে পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ায় সদ্য বাণিজ্য শুরু করেছিল ভারত। এ ক্ষেত্রে শিয়াভূমি ব্যবহার করলেও আমেরিকার নিশেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হচ্ছিল না নয়াদিল্লিকে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেই নীতি বদল করায় চিন্তা বাড়ল নরেন্দ্র মোদি সরকারের।

ইতোমধ্যেই চাবাহার বন্দরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে ভারত। গত বছর সংশ্লিষ্ট বন্দরটি নিয়ে তেহরানের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তি করে নয়াদিল্লি। সেখানে বন্দরটির উন্নতিতে বহু কোটি অর্থ লগ্নির কথা বলা আছে।

এছাড়া চাবাহার এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য ২৫ কোটি রুপি বিনিয়োগের কথা রয়েছে ভারতের। ২০১৮ সাল থেকে শিয়া মুলুকটির সমুদ্র বন্দরটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে ‘ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড’ বা আইপিজিএল নামক সংস্থা।

চাবাহার বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করেছে নয়াদিল্লি। সেখানে ভারত ও ইরান ছাড়াও রয়েছে আফগানিস্তান। আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি বদলের জেরে থেমে যেতে পারে চাবাহারের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ।

যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা নতুন নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ইরানকে দেওয়া যেকোনও আর্থিক ত্রাণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে চাবাহার বন্দর প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। বলা বাহুল্য ওয়াশিংটনের নতুন এই বিজ্ঞপ্তিতে সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হবে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় চাবাহারের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বন্দরটির শহিদ বেহেস্তি টার্মিনালের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডোর ইউরেশিয়ার সঙ্গে মুম্বাইকে যুক্ত করেছে। এই রাস্তায় পরিবহণ খরচ এবং সময় দুটিই কমবে।

২০২৩-’২৪ অর্থ বছরে চাবাহারে পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মালবাহী কন্টেইনারের সংখ্যা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। ভারতের কাছে বন্দরটির গুরুত্ব কতটা বেশি, এই তথ্যেই রয়েছে তার প্রমাণ।

আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতের দীর্ঘমেয়াদি লগ্নিকে বিপন্ন করবে। বাধা পাবে বন্দরটির পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ। ২০১৮ সাল থেকে চাবাহার দিয়ে ৯০ হাজার টিইইউ কন্টেনার এবং ৮৪ লাখ মেট্রিক টন কার্গো পরিবহণ করেছে নয়াদিল্লি।

আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা চাপানোর জেরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। ২০১৮-’১৯ অর্থ বছরে তেহরানের থেকে ১,৩০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল নয়াদিল্লি। এর মধ্যে ছিল ১,২৩৭ কোটি রুপি মূল্যের অপরিশোধিত তেল।

কিন্তু, পরবর্তী বছরগুলোতে ইরানের বদলে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে তেল আমদানি শুরু করে ভারত। ২০১৯-’২০ অর্থ বছরে তেহরানের থেকে নয়াদিল্লির পণ্য কেনার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১০০ কোটি ডলার। এই অংক আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ট্রাম্প। কুর্সিতে বসেই তিনি বলেন, “ইরান কোনওভাবেই পরমাণু হাতিয়ার রাখতে পারে না।”

তবে পারস্য উপসাগরের দেশটি যে পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, তা এক রকম স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।

তেহরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় অভিযোগ হল সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার। পশ্চিম এশিয়ায় হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুথির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যে ইরানের মদত রয়েছে বলে মনে করে ওয়াশিংটন। আর তাই শিয়া মুলুকটিকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করতে তৎপর হয়েছেন ট্রাম্প।

এই পরিস্থিতিতে ১২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটাই তার প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। সেখানে চাবাহারের সমস্যা মেটাতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে বরফ গলার আশা করছেন নয়াদিল্লির কূটনীতিকেরা।

ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব যথেষ্ট মজবুত। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে পছন্দ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চাবাহারের নিষেধাজ্ঞা সমস্যা মেটাতে এই ইতিবাচক বিষয়গুলোর উপরেই ভরসা করছে ভারত। সূত্র: ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টিভি নিউজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here