আমেরিকা-রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরো গভীর হলো ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার অচলাবস্থা। ফলে ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় ঘনবসতিপূর্ণ এই উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় আরো চরম পর্যায়ে পৌঁছার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ ত্রাণ ও জরুরি পণ্য সরবরাহের সুবিধার্থে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তা রাশিয়া ও চীনের আপত্তির কারণে বাতিল হয়ে গেছে। এই দুই দেশের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতও বিপক্ষে ভোট দেয়।
অন্যদিকে, গত ১৬ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে গাজায় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় চীন, গ্যাবন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে অপর দুই স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আপত্তির কারণে সেই প্রস্তাব পাস হতে পারেনি। এছাড়া আলবেনিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, ফ্রান্স, ঘানা, জাপান, মাল্টা, মোজাম্বিক ও সুইজারল্যান্ড রাশিয়ার এই প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত ছিল।
গত শনিবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ইসরায়েল ও হামাসের চলমান এই যুদ্ধ নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই প্রস্তাবের বক্তব্য ছিল— ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এই ইরান যেন হামাসকে অস্ত্র প্রদান বন্ধ করে— সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া। গাজায় মানবিক বিরতির ব্যাপারটি সেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর হামলায় প্রতিদিন যেখানে শত শত শিশু-নারী ও বেসামরিক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হচ্ছে, সেখানে ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ পক্ষে সাফাই দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই খসড়া প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য। তারপর পরিষদের মঙ্গলবারের বৈঠকে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ ও মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাজায় ‘মানবিক বিরতি’ ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে চুড়ান্ত প্রস্তাব তোলে যুক্তরাষ্ট্র।
বুধবার সেই প্রস্তাবের ওপর ভোটগ্রহণ হয়। এই পর্বে শুরুতেই এতে ভেটো বা আপত্তি জানায় নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন এবং রাশিয়া। জাতিসংঘের রুশ প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া তার বক্তব্যে বলেন, “এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আসলে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য স্থল অভিযানের পরিবেশ সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে। যেখানে বিমান হামলায় গাজায় প্রতিদিন শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তা পরিষদ এই যুদ্ধকে আরো বিস্তৃত করার অনুমোদন দিতে পারে না।”
আর জাতিসংঘের চীনা প্রতিনিধি ঝ্যাং জুন বলেন, “পুরো বিশ্ব গাজায় আল আকসা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি ও সংঘাতের অবসান চাইছে। এই প্রস্তাবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। এই মুহূর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতে কেবল কূটনৈতিক কোনো পদক্ষেপ নয়, বরং সেখানে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের জীবন-মরণ এর সঙ্গে সম্পর্কিত।”
তবে রাশিয়া ও চীনের আপত্তি সত্ত্বেও ভোটপর্বে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১০টি এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং ব্রাজিল ও মোজাম্বিক ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে।
ভোটপর্ব শেষে জাতিসংঘের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড চীন ও রাশিয়ার ভেটোতে হতাশা জানিয়ে বলেন, “আমরা আপনাদের সবার কথা শুনেছি। আমাদের আজকের প্রস্তাব পাস হলো না, তবে আমরা হাল ছেড়ে দিইনি।”
এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য মাল্টার জাতিসংঘ প্রতিনিধি ভানেসা ফ্রেজিয়ার জানিয়েছেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ইস্যুতে নতুন একটি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য কাজ করছে নিরাপত্তা পরিষদ।
তিনি বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে তা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তা ছড়িয়ে পড়ার গুরুতর ঝুঁকি রয়েছে। এই সংকট সমাধানে অবশ্যই আমাদের মনযোগী হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এটাই আমাদের দায়িত্ব।”
গত ৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালায় গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিন প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিন থেকেই গাজায় বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী।
তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই যুদ্ধে ইসরায়েলে নিহত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন। গাজায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ৬ হাজার। এই নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। সূত্র: ইউএন ওয়েবসাইট, রয়টার্স