আফ্রিকায় ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়াচ্ছে রাশিয়া। এই কাজে ভাড়াটে সেনা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’কে কাজে লাগাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মধ্য আফ্রিকায় বড় আকারের সেনাছাউনি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে মস্কোর। বিপরীতে আফ্রিকায় দিনে দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে।
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, ২০১৭ সাল থেকে আফ্রিকায় আক্রমণাত্মক বিদেশনীতি অনুসরণ করছে রাশিয়া। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটির অন্তত ছয়টি দেশকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে মস্কো। সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে রুশ ভাড়াটে সেনা ‘ওয়াগনার।
বর্তমানে মধ্য আফ্রিকার একাধিক দেশ ক্রমাগত বিদ্রোহী এবং চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে সেখানকার সরকারকে সাহায্য করছে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’। এভাবেই ধীরে ধীরে মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর সরকার থেকে শুরু করে আমজনতার ‘নয়নের মণি’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে রাশিয়া।
আফ্রিকায় ‘ওয়াগনার গ্রুপ’-এর জয়যাত্রা শুরু হয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান দিয়ে। ২০১৩ সালে থেকে সেখানে একরকম গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি রয়েছে। ওই বছর ক্ষমতা দখল করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ফলে মসনদ ছাড়তে হয় প্রেসিডেন্টকে। ২০১৯ সালে ১৪টি সশস্ত্র গোষ্ঠী শান্তি চুক্তিতে সই করে। কিন্তু কিছু দিন পরেই ছয়টি দল সেই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যায়। ফলে ফের শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা।
স্থানীয়দের দাবি, এর পরই মাঠে নামে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের যোদ্ধারা। তাদের সঙ্গে যুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা পেরে উঠতে পারেনি। ফলে ২০২১ সালে রাজধানী বাঙ্গুই ছেড়ে পালায় তারা। এতে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানে ফেরে শান্তি। আর এর ষোলো আনা কৃতিত্ব ‘ওয়াগনার গ্রুপ’কেই দিয়ে থাকেন মধ্য আফ্রিকার দেশটির বাসিন্দারা।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানের পাশাপাশি নাইজার, মালি এবং বুরকিনা ফাসোয় রুশ ভাড়াটে বাহিনীর সাহায্যে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান মজবুত করেছে মস্কো। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটির অন্যান্য রাষ্ট্রেও এই একই পদ্ধতিতে প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। পাশাপাশি ধীরে ধীরে সেখানকার দেশগুলিতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলছেন তিনি।
২০২৪ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানের রাজধানী বাঙ্গুই থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে একটি সেনা ছাউনি নির্মাণের কাজ শেষ করে রাশিয়া। ২০৩০ সালের মধ্যে মস্কো সেখানে ১০ হাজার বাহিনী মোতায়েন করবে বলে জানা গেছে। মধ্য আফ্রিকার দেশটির রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার বিকান্তোভ জানিয়েছেন, ‘‘এখানকার নিরাপত্তার উন্নতির জন্য এই ধরনের একটি ঘাঁটির খুবই প্রয়োজন ছিল।’’
আফ্রিকায় রুশ প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সদস্য স্যামুয়েল রামানি। তার কথায়, ‘‘বিশ্বের বৃহত্তম মহাদেশটিতে লাগাতার আমেরিকা-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে মস্কো। কারণ আফ্রিকায় জমি হারালে আর্থিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বড় লোকসানের মুখে পড়বেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।’’
রামানির দাবি, সেই কারণেই সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানে নিজেদের অবস্থান দিন দিন আরও মজবুত করছে রাশিয়া। সেখানে পায়ের তলার মাটি সরে গেলে আফ্রিকার অন্য দেশগুলিতেও মস্কোর চাল মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আফ্রিকায় রুশ ভাড়াটে সেনা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’-এর বিরুদ্ধে যে কোনও অভিযোগ নেই, তা ভাবলে ভুল হবে। ২০২২ সালে মালিতে প্রায় ৩০০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সেখানকার সেনা। তাদের সঙ্গে ছিলেন ওয়াগনার যোদ্ধারা। সাজাপ্রাপ্তদের নিরপরাধ সাধারণ মালিবাসীও ছিলেন বলে অভিযোগ।
রুশ ভাড়াটে সেনা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’কে অনেকেই প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিজস্ব বাহিনী হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। একটা সময়ে এর প্রধান ছিলেন তাঁর রাঁধুনি অলিগার্চ ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে মস্কো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ডনবাস এলাকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কব্জা করতে এই ওয়াগনারকে কাজে লাগিয়েছিলেন পুতিন।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে লিবিয়া, সিরিয়া, মোজাম্বিক, সুদানের মতো দেশে গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছিল এই রুশ ভাড়াটে বাহিনী। কিন্তু ২০২৩ সালে হঠাৎ করেই বিদ্রোহী হন প্রিগোঝিন। রণক্ষেত্র ছেড়ে মস্কোর দিকে বাহিনী নিয়ে এগোতে শুরু করেন তিনি। যদিও সেই ‘বিদ্রোহ’ সফল ভাবে মোকাবিলা করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এর পর ওই বছরের অগস্ট মাসে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ওয়াগনার প্রধান।
মারা যাওয়ার আগে অবশ্য একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন প্রিগোঝিন। সেখানে হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল তাকে সাহারা মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আফ্রিকার মানুষকে মুক্তি এবং আনন্দের স্বাদ দিতে এবং তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ কাজ করবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সূত্রের খবর, প্রিগোঝিনের মৃত্যুর সময়ে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানে রুশ ভাড়াটে সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার।
রুশ ভাড়াটে বাহিনীর প্রধান প্রিগোঝিনের মৃত্যুর পর আফ্রিকায় মস্কো জমি হারাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২০২২ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানের সরকারকে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’-এর বিকল্প খুঁজতে চাপ দেয় আমেরিকা। কিন্তু তাতেও তেমন কাজ হয়নি।
২০২৩ সালে আমেরিকার বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ‘ব্যানক্রফ্ট গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট’-এর সঙ্গে বৈঠক করে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান সরকার। ওই বছরই তাঁদের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয়। তার পরও মধ্য আফ্রিকার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাটি ‘ওয়াগনার বাহিনী’র বিকল্প হয়ে উঠেছে, তা বলা যাবে না।
ওয়াশিংটনের সংস্থা ‘ব্যানক্রফ্ট গ্লোবাল’-এর জন্ম হয় ১৯৯৯ সালে। শুরু দিকে এর নাম ছিল ‘ল্যান্ডমাইন ক্লিয়ারেন্স ইন্টারন্যাশনাল’। ২০১১ সালে নিজেদের নাম বদল করে ওই সংস্থা। বর্তমানে মোট ন’টি দেশে মোতায়েন রয়েছেন এর রক্ষীরা। এর মধ্যে পাঁচটি রাষ্ট্র আফ্রিকার। বাঙ্গুইতেও পা পড়েছে তাদের।
আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে রয়েছে চিন এবং তুরস্কও। বিশ্বের বৃহত্তম মহাদেশটিতে একাধিক সেনাঘাঁটি তৈরি করেছে বেইজিং।
অন্য দিকে বিবদমান আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে তুরস্ক। সম্প্রতি এই মহাদেশটিতে বেড়েছে ইউরোপের দেশটির পণ্যের চাহিদা। এ ছাড়া সেখানকার খনি এবং নির্মাণ-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছে আঙ্কারার একাধিক সংস্থা।