ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাপরতলা ইউনিয়নের কালিউতা গ্রামে প্রতিদিন ভিড় করছেন শত শত মানুষ। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুরা অপেক্ষায় রহস্যময় এক কবিরাজের। কারও হাতে বোতল, কারও হাতে কমলা, আবার কেউ এনেছেন গাছের ডাল ও মুড়ি। কিছুক্ষণ পর বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ‘কমলা কবিরাজ’।
কবিরাজ হাতে থাকা পচা কমলা ও গাছের ডাল নিয়ে অদ্ভূত ভঙ্গিতে ঝাঁড়ফুঁক শুরু করেন। রোগীরাও সমস্বরে আল্লাহু আকবার বলে স্লোগান দেন। রোগীদের হাতে থাকা জিনিসে ফুঁ দিয়ে তান্ত্রিক আচার পালন করেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই অপচিকিৎসার আসর।
কমলা কবিরাজের আসল নাম জুনাইদ আহমেদ। তিনি উপজেলার চাপরতলা ইউনিয়নের কালিউতা গ্রামের বাতেন মিয়ার ছেলে। একসময় তিনি আইসক্রিম বিক্রি করতেন। বছরখানেক আগে তিনি দাবি করেন, গভীর রাতে এক ‘জ্বিন’ তাকে কবিরাজি চিকিৎসার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে। এরপর তিনি পেটের ব্যথার রোগীদের কমলা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। কোন এক কাকতালীয় কারণে কেউ সুস্থ হয়ে গেলে তা দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় বাড়তে তাকে, আর ‘কমলা কবিরাজ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন জুনাইদ।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রথম দিকে গ্রামের লোকজন এই কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ইউনিয়নের কিছু প্রভবশালী ব্যক্তি এই প্রতারণার ভাগীদার বলে অভিযোগ রয়েছে।
কমলা কবিরাজের আসর ঘিরে আশপাশের এলাকায় কমলা ও নিমগাছের ডালের চাহিদা বেড়ে গেছে। স্থানীয় দোকানিরা বাড়তি লাভে এসব বিক্রি করছেন। কবিরাজের চিকিৎসার নামে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জনের এই প্রবণতা এখন স্পষ্ট।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, হবিগঞ্জের নুর উদ্দিন নামে এক প্যারালাইসিস রোগীকে গাছের ঢাল দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে, এর পর সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করে বলা হচ্ছে-তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন। নুর উদ্দিন বলেন, ‘তেল মালিশ করায় একটু ভালো লাগছে, কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়েছি কি না জানি না।
লাখাই উপজেলার লুৎফা নামের এক কিশোরী এসেছেন, যিনি জানেনই না তিনি কী রোগে আক্রান্ত! কবিরাজ তার ‘জিন’-এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করবেন, এর পর কমলা পড়া ও গাছের ঢাল দিয়ে ঝাড়ফুঁক করলে তিনি ভাল হয়ে যাবেন-এমনটাই তার বিশ্বাস।
সালমা বেগম নামের এক বৃদ্ধা এসেছেন নাতনি কেয়াকে নিয়ে। পড়াশোনায় মনোযোগী নয়, তাই কবিরাজের ‘কমলা পড়া’ নিলে সে ভালো ছাত্রী হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। স্থানীয় ইসলামিক চিন্তাবিদ আতাউর রহমান গিলমান জানান, ‘কুরআন-হাদিসে এমন কোন চিকিৎসার কথা নেই। এসব কবিরাজি অপচিকিৎসা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং মানুষকে প্রতারিত করার একটি পদ্ধতি মাত্র।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, এগুলো চিকিৎসা নয়, সম্পূর্ণ প্রতারণা। গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল, নিরক্ষর মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষিত কেউ কবিরাজের কাছে যান না। প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
চাপরতলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনুসর মিয়া দাবি করেন, এক সময় আইসক্রিম বিক্রি করা জুনাইদ আজ কবিরাজ হিসেবে পরিচিত। অথচ তার চিকিৎসার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ধর্মীয় বা চিকিৎসাবিদদের কেউই এসব পদ্ধতির স্বীকৃতি দেন না। নাসিরনগর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুল আলম বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনা নাসরিন জানান, যদি কোন ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।