অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও করপোরেট খাত রক্ষায় পদক্ষেপ চান উদ্যোক্তারা

0

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় চাপ বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। উদ্যোক্তারা বলছেন, ঋণের উচ্চ সুদহার দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই বারবার ব্যাংকঋণে সুদহার বৃদ্ধিতে চরম সংকটে পড়েছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে থমকে আছে বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশির ভাগ উদ্যোক্তা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের পরিবেশ নেই; তাঁরা টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ব্যাংকঋণের সুদ ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে ঋণের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

সম্প্রতি এলসি খোলার হার কমেছে। শিল্প উৎপাদনে এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নতুন সুদহার মূল্যস্ফীতি কমাবে বলে আমি মনে করি না। বরং এতে শিল্পের ভোগান্তি বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীরা ঋণখেলাপি হতে পারেন। এত ঋণ ব্যয় নিয়ে উদ্যোক্তারা কিভাবে টিকে থাকবেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের ফলে বছরের ব্যবধানে শিল্পঋণের ব্যয় প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির চাপ, অস্থিতিশীল অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি ভোগ, বিনিয়োগ ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য রুগ্ণ করপোরেট খাতকে জাগিয়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ হচ্ছে করপোরেট খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে বেশ কিছু প্রণোদনা প্রদান। 

সম্ভাব্য উদ্যোগগুলো হতে পারে-

কম সুদে ঋণ : কম সুদে ঋণ বা ঋণের নিশ্চয়তা দেওয়া হলে করপোরেট খাতে নগদ প্রবাহ পরিচালনা করা এবং প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা সহায়ক হবে।

অনুকূল আর্থিক শর্ত : জাতীয়ভাবে প্রকল্প ও সেক্টর বা কম্পানিগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি, কম সুদ, পুনর্গঠন সুবিধাসহ ডাউনপেমেন্ট ছাড়া বা কম ডাউনপেমেন্টে অর্থায়ন, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরালো হয় এবং পুনরুদ্ধার গতি পায়।

আন্তর্জাতিক উদার ব্যাংকিং প্রচলন : করপোরেট ও ব্যাংকিং খাতের জন্য সহায়ক হয় এমন আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন-রিকোর্স, কম জামানতপূর্ণ, পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা, কম সীমাবদ্ধ আমদানি সুবিধা, সেকেন্ডারি ঋণ বাজার ইত্যাদি প্রবর্তন করা।

ভর্তুকি : কাঁচামাল ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় উপকরণে ভর্তুকি প্রদান। এতে উৎপাদন খরচ ও মূল্যস্ফীতি কমবে, বিপরীতে প্রতিযোগিতা বাড়বে।

অনুদান : যেসব খাতে বিনিয়োগ বেশি জরুরি, সেসব খাতে অনুদান বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং এভাবে আমদানিনির্ভরতা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি হ্রাস করতে পারে।

কর ছাড় ও কর রেয়াত : মূল শিল্পগুলোর জন্য সাময়িক কর ছাড় বা কর রেয়াত সুবিধা ব্যবসার ওপর আর্থিক বোঝা কমাবে এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে।

করপোরেট করহার কমানো : ম্যানুফ্যাকচারিং ও প্রযুক্তির মতো নির্দিষ্ট খাতে করপোরেট করহার কমানো হলে প্রবৃদ্ধি জোরালো হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।

ট্যাক্স ক্রেডিট ও ভাতা : মূলধনী বিনিয়োগ এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ট্যাক্স ক্রেডিট প্রদান উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করতে পারে।

পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারি (পিপিপি) : অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য পিপিপিকে উৎসাহিত করা ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘এমন দেশ নেই, যেখানে ব্যবসায়ীরা দুই অঙ্কের ব্যাংক সুদহারে মুনাফা করতে পারেন। সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। তাদের সমস্যার কথা শুনতে হবে।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘করহারে ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারীই চান একটি বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামো ও নীতির ধারাবাহিকতা। সেটি নিশ্চিত করা গেলে অর্থনীতিতে স্বস্তি আসার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হবে।’

এছাড়া বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামী দিনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারবে বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, দেশে বিদ্যমান বাস্তবতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য নয় এমন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়া, আমদানি-রপ্তানিতে নিম্নগতিসহ বিভিন্ন কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ফলে টান পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের আয়ের খাতে।

দেশের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন খাতে বাড়তি ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে বহু উদ্যোক্তা এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার অব্যাহত থাকলে শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সুদের হারের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। তা না হলে উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান- সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here