অনিশ্চয়তায় ধুঁকছে বস্ত্র খাত

0

দেশের অগ্রসরমান অর্থনীতিতে একক পণ্যনির্ভর বস্ত্র ও পোশাক খাত। ৮৩ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয়ের উৎস এই খাত। রপ্তানি পণ্যের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সুতা ও কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দিয়ে থাকে দেশের বস্ত্রকলগুলো।

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে জোগান দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে চাহিদা মিটিয়ে আসছে এসব কারখানা।

বিগত সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরূপ প্রভাব অন্যান্য খাতের মতো বস্ত্র খাতেও পড়েছে। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বর্তমানে এ খাতটি মহাসংকটে পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আন্তর্জাতিক চালে আটকে গত কয়েক বছরে অসংখ্য টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুতাকলগুলোও।

যেগুলো চালু আছে, সেগুলোতে উৎপাদিত সুতা বিক্রি হচ্ছে না। বেশির ভাগ দেশীয় সুতা ও বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পেও পড়তে শুরু করেছে এর নেতিবাচক প্রভাব।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক চক্র অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলাদেশের পুরো বস্ত্র খাতকে করায়ত্তে নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনে ভিনদেশিদের একচেটিয়া ব্যবসার জেরে বাংলাদেশকে পুতুল হয়ে থাকতে হবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সুতা ও বস্ত্র খাতের বাজার পুরোপুরি দখল করতে সুকৌশলে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। একদিকে তাদের দেশে তারা এই খাতকে দিচ্ছে আকর্ষণীয় প্রণোদনা (ইনসেনটিভ) সুবিধা, অন্যদিকে ব্যাংকঋণের সুদের হারও রেখেছে সর্বনিম্ন। ফলে বাংলাদেশের তুলনায় তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দুষ্টচক্রের কারসাজি তো রয়েছেই। এ ছাড়া পণ্য উৎপাদন করতে গেলে শিল্পমালিকদের দেশেও গ্যাস-বিদ্যুতের চরম সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।

উদ্যোক্তারা বলেন, দেশের সুতা কারখানাগুলোর ওপর উচ্চ সার্ভিস চার্জ এবং চক্রবৃদ্ধি হারে ব্যাংকঋণের সুদও এ খাতকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বস্ত্র খাতের এমন সংকটে স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী পোশাকের কাঁচামালের দেশীয় জোগান এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর উৎপাদনসক্ষমতার ৩৫ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে না। ক্রমাগত আর্থিক লোকসানে অন্তত ৫০টি বড় বস্ত্রকল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে দেশে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই দফায় বস্ত্র খাতের নগদ সহায়তা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২ থেকে ৩ সেন্ট কম পেলেই বিদেশি ব্র্যান্ড-ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ অন্যত্র সরিয়ে নেন। পোশাকের রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে তুমুল এই দর প্রতিযোগিতার কারণে বাধ্য হয়ে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা স্থানীয় কাঁচামালের বদলে আমদানিতে ঝুঁকছেন।

৬ মাসে সুতা আমদানি বেড়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৪৭৫ টন

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে আগের একই সময়ের চেয়ে সুতা আমদানি বেশি হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৪৭৫ টন। এ সময়ে সুতা ও কাপড়ের কাঁচামালের মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার ১৫৯ টন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার লাখ ১৩ হাজার ৬৮৪ টন। বাড়তি আমদানিতে পাঁচ হাজার ৫৫৭ কোটি ৮৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ টাকা ব্যয় হয়েছে। বস্ত্র খাতের লিটিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলমের মতে, এনবিআরের তথ্য প্রকৃত আমদানির এক-তৃতীয়াংশেরও কম। তিনি বলেন, অসত্য তথ্য দিয়ে অনেক সুতা ও কাপড় দেশে আসছে। চোরাই পথে আসে তার চেয়েও বেশি।

ইউরোপে জিএসপি প্লাস নিয়ে শঙ্কা

দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। স্বল্পোন্নত দেশ—এলডিসি হিসেবে জোটে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এলডিসি কাতার থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। অবশ্য উত্তরণের পর অতিরিক্ত তিন বছর এই সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ২০২৯ সালের পর নতুন স্কিম জিএসপি প্লাস সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে ইইউয়ের নির্বাহী সংস্থা ইউরোপীয় কমিশন এরই মধ্যে জানিয়েছে, জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে অন্যান্য শর্তের সঙ্গে উৎস বিধির শর্তে স্থানীয় বস্ত্র ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকবে। কিন্তু আমদানিনির্ভরতায় দেশীয় বস্ত্র খাত দুর্বল কিংবা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লে ইইউ জোটে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে না। পোশাকে মূল্য সংযোজন আরো কমবে। ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের দীর্ঘমেয়াদি সংকট পোশাক রপ্তানিতে বাজে পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

স্থানীয় বাজারও এখন আমদানিনির্ভর

বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, বস্ত্র ও পোশাকের স্থানীয় বাজারের আকার ১৪ হাজার কোটি টাকা। কাপড়ের চাহিদা বছরে আট বিলিয়ন মিটার। রপ্তানিযোগ্য সুতা ও কাপড়ের পাশাপাশি স্থানীয় বস্ত্রের শতভাগ চাহিদা দেশীয় বস্ত্রকল মেটাতে সক্ষম। বিটিএমএর সদস্য কারখানা ৫১৯টি। এর মধ্যে শতভাগ স্থানীয় বাজারের জন্য সুতা তৈরি করে ২০০ কারখানা স্থানীয় বস্ত্রের জোগান দিয়ে থাকে। বিদেশি বস্ত্রের অসম দর এবং অবৈধ প্রবেশে স্থানীয় বস্ত্র খাত সংকটে পড়েছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here