সংকট বাড়ছেই পোশাক খাতে

0
সংকট বাড়ছেই পোশাক খাতে

দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র রপ্তানি খাত অনিশ্চয়তার কবলে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রেতাদের আস্থার সংকট এবং বিভ্রান্তিকর সরকারি বার্তা—সব মিলিয়ে বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেওয়া থেকে সরে যাচ্ছে। কমপ্লায়েন্স বা নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা হুট করে বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। বরং কারখানাগুলোতে পরিপালনযোগ্য ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা বন্ধ হওয়া খারাপ কিছু নয়।’ তাঁর মতে, এটি শিল্পের সুষ্ঠু ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তবে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত পোশাকশিল্পে নেতিবাচক ও জটিল প্রভাব ফেলতে পারে।

এদিকে গতকাল প্রকাশিত সর্বশেষ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য থেকে রপ্তানির নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। এমনিতেই নতুন অর্থবছরের প্রথম থেকেই পণ্য রপ্তানিতে পতন চলছে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসও সে ধারায়ই শেষ হলো। মাসটিতে রপ্তানি কমেছে গত বছরের একই মাসের চেয়ে ৭ শতাংশেরও বেশি।

এতে দেখা যায়, রপ্তানি কম হয়েছে ৫১ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকার মতো। গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি হয় ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য। গেল অক্টোবরে তা ৩৬২ কোটি ডলারে নেমে এলো। এ নিয়ে রপ্তানি কমল টানা তিন মাস।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো বিশ্বমানের নিরাপত্তা ও কাঠামোগত সংস্কার সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে; কিন্তু এখনো কিছু কারখানা সেই মানদণ্ডে পৌঁছতে পারেনি।

সরকারের দায়িত্ব ছিল এই কারখানাগুলোর সংস্কার ও তদারকি জোরদার করা; কিন্তু সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য না দেখিয়ে এখন সরকার নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা বন্ধের দিকেই ঝুঁকছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে অন্তত ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এক লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এ তথ্য দেন।

এ সময় বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘বিগত এক বছরে ২৫৮টি কারখানা তাদের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে ক্ষুদ্র বা মাঝারি পরিসরে টিকে থাকার চেষ্টা করছে; কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিদ্যুৎসংকট, মজুরি সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে একই সময়ে নতুন ১৬৬টি কারখানা চালু হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি সক্ষমতা উভয় ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরো বলেন, কারখানা বন্ধের কারণে শুধু উৎপাদনই নয়, শ্রমিকদের জীবিকা, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। চাকরি হারালে পরিবারগুলোর আয় কমে যাচ্ছে, অনেকে বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, শিশুদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘কার্যাদেশ কমে যাওয়া’ এবং ‘ক্রেতাদের আস্থাহীনতা’—এই দুটি বিষয় সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হয়ে উঠছে।

শিল্প রপ্তানির দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সরবরাহ স্থিতিশীলতা ও আস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। যদি বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে কারখানা বন্ধ হতে থাকে, তাহলে অনেক ক্রেতা বিকল্প দেশ যেমন—ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারেন।

শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, নন-কমপ্লায়েন্স ইস্যুটি শুধু শাস্তিমূলক নয়, বরং এটি শিল্পনীতি, শ্রমিক সুরক্ষা, রপ্তানি সক্ষমতা ও বৈদেশিক ভাবমূর্তির সমন্বিত বিষয়। তাই সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উচিত একযোগে পরিকল্পনা নিয়ে দুর্বল কারখানাগুলোকে সংস্কার ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা, যাতে শিল্পের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

জানতে চাইলে শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স বা নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা হুট করে বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়, বরং কারখানাগুলোকে পরিপালনযোগ্য ও উপযুক্ত পরিবেশে নিয়ে আসতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ছোট-বড় সব কারখানায় বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে। তাই হঠাৎ বন্ধ হলে সরবরাহব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে এবং ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যায়। তবে পোশাক খাতে কিছুটা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা গেলেও দেশের শিল্প-কারখানার বড় একটি অংশ এখনো অধরা। তাই কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া সব ক্ষেত্রে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অংশীদারি বাড়াতে হবে, যা এখনো পর্যাপ্তভাবে হয়নি।’

‘কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’, উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘বিজিএমইএ সভাপতি প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎও পাচ্ছেন না; তাহলে তিনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন কেন? তাঁর মুখপাত্র উল্টাপাল্টা কথা বলেন, ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ান। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত মরছি; কারখানা বন্ধ হচ্ছে, মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, আর তিনি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কপাল আগেই পুড়েছে, এখন কারখানা, বাড়ি, এমনকি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও পুড়ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। সাম্প্রতিক এই সংকট শুধু শিল্প মালিকদের নয়, বরং সার্বিক অর্থনীতির ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার বাজারে মন্দা, চাহিদা কম এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে রপ্তানি কমছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সর্বজ্ঞানী মুখপাত্রের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের কারণে ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।’ তাঁর প্রশ্ন হলো দেশের বড় এবং কমপ্লায়েন্স কারখানা ভিয়েলাটেক্স বন্ধ হয়েছে। এটা কিসের আলামত!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here