বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শঙ্কার মধ্যেই দেশে একের পর এক মাসুল (চার্জ) আরোপ করা হচ্ছে। অফডক মালিকদের সংগঠন বিকডা কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ মাসুল বাড়ানোর পর ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনও (বাফা) প্রতি আমদানি ডকুমেন্টে মাসুল ৫৭ শতাংশ বাড়িয়েছে। এতে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
এ পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এরই মধ্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া মাসুল বৃদ্ধির প্রতিবাদে এফবিসিসিআই আজ বুধবার পর্যালোচনাসভার আয়োজন করেছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ হারে মাসুল বাড়িয়েছিল অফডক মালিকদের সংগঠন বিকডা (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন)। এর মধ্যে ২০ ফুটের প্রতিটি কনটেইনার এক্সপোর্ট স্টাফিং মাসুল পাঁচ হাজার ৯২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ছয় হাজার ৩৬৫ টাকা করা হয়। আর ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রতি কনটেইনারে ছয় হাজার ৭৯০ টাকা থেকে আট হাজার ৪৮৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এটা ২০২০ সালেও ছিল পাঁচ হাজার ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া আমদানি পণ্যের হ্যান্ডলিং মাসুল ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০ ফুটের কনটেইনারে ১১ হাজার ২৫৫ টাকার জায়গায় মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ১০৭ টাকা।
বিজিএমইএর হিসাবে, ২০২১ সালে প্রাইভেট আইসিডির মাধ্যমে শুধু এক্সপোর্ট হ্যান্ডলিং প্যাকেজ মাসুল বাবদ ২৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে আনুমানিক ৫০ কোটি টাকা খরচ বেড়ে যায়। আর চলতি বছর এক্সপোর্ট হ্যান্ডলিং প্যাকেজ মাসুল বাবদ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে প্রায় ১০৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) আগে প্রতিটি আমদানি ডকুমেন্টের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা মাসুল নিত। অভিযোগ উঠেছে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই মাসুল একতরফাভাবে দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৫৭ শতাংশ। একইভাবে বিএল ও মাস্টার বিএল স্ট্যাম্প মাসুলও শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা আমদানিতে বিএল প্রতি ডেস্টিনেশন মাসুল ২০২২ সালে ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর ফলে ৫৪৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে বলে বিজিএমইএ নেতারা জানান। প্রসঙ্গত, প্রতি মাসে ২৫ হাজারের বেশি আমদানি ডকুমেন্ট জমা পড়ে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কাছে, যার বেশির ভাগেই তৈরি পোশাক খাতের।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। স্প্রিং সিজনের অর্ডার প্রায় ৩০ শতাংশ কম এসেছে। ভবিষ্যতে অর্ডারগুলো ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের লজিস্টিক খরচগুলো কমিয়ে আনতে হবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় যেখানে সাত হাজার ডলার ফ্রেইট চার্জ দিতে হয়, সেখানে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ডলার দিতে হচ্ছে। এই চার্জটা বায়ারকে দিতে হচ্ছে। খুচরা মূল্যের সঙ্গে এই বাড়তি খরচ হিসাব করলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখানে ফরোয়ার্ডারদের থেকে এনওসি নিতে বাড়তি চার্জ দিতে হচ্ছে। রপ্তানির সময় বিএল চার্জটা বাড়তি দিতে হচ্ছে। তেলের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে অফডকের চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলো যতক্ষণ বন্ধ না হবে, ততক্ষণ আমাদের এই অর্ডারগুলো ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। ’
একই কথা বললেন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের ফেইট চার্জ হয় পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার ডলার, আর আমাদের হয় ১৩ থেকে ১৪ হাজার ডলার। এর মধ্যে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা ৫৩ থেকে ৫৫ শতাংশ চার্জ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে প্রতিযোগিতা থেকে আমরা আরো দূরে সরে যাব। ’
তবে মাসুল বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিজিএমইএর অভিযোগ মানতে নারাজ বিকডা কিংবা বাফা। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণেই অফডকগুলো মাসুল বাড়িয়েছে বলে দাবি বিকডার। আর বাফার দাবি দীর্ঘ প্রায় আট বছর পর তারা মাসুল বাড়িয়ে সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বিকডা মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, ‘সরকার তেলের দাম প্রথম সাড়ে ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি করলেও পরে পাঁচ টাকা কমিয়ে ৩৬ শতাংশ করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের অপারেশনাল খরচ আছে সেটা সমন্বয় করতে হবে। আমাদের বেশির ভাগ ট্রেলর এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট ডিজেলনির্ভর। মূল্য সমন্বয় ছাড়া আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারব না। এ কারণে আমাদের চার্জগুলো সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বসেই বৃদ্ধি করেছি। ’ মাসুল বৃদ্ধিতে নিয়মনীতি না মানার অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ কোন নিয়মনীতির কথা বলছে আমরা বুঝতে পারছি না। যদি ট্যারিফ কমিটির কথা বলেন, সেটি আদালতে বিচারাধীন। তবে আমরা সব সময় বলেছি, বেসরকারি খাতের কোনো চার্জ সরকারি ট্যারিফের মাধ্যমে নির্ধারণ করাটা কতটা আইনসংগত, সেই প্রশ্নটা বিশ্লেষণের দাবিদার। ’
বাফা পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘২০১৪ সালের পর আমরা কোনো ধরনের খরচ বাড়াইনি; কিন্তু এখন জীবন যাত্রার মান বেড়ে গেছে, সব ধরনের খরচ বেড়ে গেছে, সব কিছু চিন্তা করে প্রতি ডকুমেন্টে দুই হাজার টাকা বৃদ্ধি করে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছি। ব্যাবসায়িক শৃঙ্খলার জন্য আমরা প্রতি ডকুমেন্টে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছি। কেউ চাইলে এর চেয়ে কমেও কাজ করতে পারবে কিন্তু এর ওপরে না। ’