বাবা-মায়ের কবরে সমাহিত ফরিদা পারভীন

0
বাবা-মায়ের কবরে সমাহিত ফরিদা পারভীন

কুষ্টিয়ায় বাবা মায়ের কবরে সমাহিত হলেন ‘লালন সম্রাজ্ঞী’ খ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। রবিবার বাদ এশা পৌর গোরস্থানের সামনে নির্ধারিত জানাজার স্থানে জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রথমে বাদ মাগরিব জানাজা এবং দাফনের কথা থাকলেও ঢাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মরদেহ কুষ্টিয়ায় এসে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় পরবর্তীতে পরিবারের পক্ষ থেকে বাদ এশা জানাজা এবং দাফনের সময় ঘোষণা করা হয়।

রবিবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে শিল্পী ফরিদা পারভীনকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সটি কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে এসে পৌঁছে। সেখানে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শিল্পীর ছেলে ইমাম নাহিল সুমনসহ পরিবারের সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন, বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, বিশিষ্ট লালন গবেষক লালিম হক, লালন একাডেমির শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানাজায় অংশ নেন। প্রিয় এ শিল্পীকে শেষ বিদায় জানাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আগে থেকেই সেখানে শত শত মানুষ ভিড় জমান। বৃষ্টিস্নাত গোরস্থানে সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় নেন প্রখ্যাত লালন সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। 

এ সময় অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার সাংবাদিকদের বলেন, ফরিদা পারভীনকে শুধু শিল্পী বললে অন্যায় হবে। তাঁর অবদানটা শিল্পী হিসেবে না। তিনি ফকির লালন শাহকে পরিচিত করেছেন সারা বাংলাদেশে, এ উপমহাদেশে সারা বিশ্বে। এর মানে টা কী? এর মানে টা হলো এই এর আগে আমরা ফকির লালন সম্পর্কে জানতাম একজন পল্পী গীতি হিসেবে শুনতাম। আব্দুল আলীম পল্লী গীতি আকারে গাইতেন। এভাবে শুনতাম। কিন্তু ফরিদা যখন গাইলেন আমরা প্রথম বুঝলাম আমরা একজন সাধকের গান শুনছি। বাংলার ভাবজগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের চমৎকার গান শুনছি। এই কাজটা ফরিদা করেছেন। তিনি প্রথম করেছেন। প্রথম যিনি করেন তাঁর কজটা অবদানটা এমনই অসামান্য। এটা পূরণ হবার যোগ্য না।  ফরিদা পারভীন একটা ধারা তৈরি করে দিয়েছেন। যেই ধারা থেকে আমরা গড়ে উঠেছি। কুষ্টিয়াবাসীর জন্য সত্যিকার অর্থেই আজ দুঃখের দিন। কুষ্টিয়াকে সত্যিকার অর্থেই আমরা সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এটা হবে উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক নগরী। সেই ভিত্তিটা ফরিদা পারভনি তৈরি করে গেছেন।  

১৯৫৪ সালে নাটোরের সিংড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন। ছোট বেলা থেকেই সঙ্গীত পরিবারে বেড়ে ওঠা। দাদি গান করতেন, বাবার ছিল গভীর অনুরাগ। ছোটবেলা কেটেছে মাগুরায়। স্কুলজীবনের শুরু মাগুরাতেই। সঙ্গীতে প্রথম হাতেখড়ি ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। বাবার চাকরির কারণে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করলেও দীর্ঘদিন ছিলেন কুষ্টিয়ায়। এখানকার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক। 

এই শহরেই দীর্ঘদিন তিনি চর্চা করেছেন লালনগীতির। তবে তাঁর পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে ১৪ বছর বয়সে। ওই বয়সেই রাজশাহী বেতারে নজরুল শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। প্রথমে গেয়েছেন নজরুল, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান। তার কণ্ঠে গাওয়া ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ এখনো স্মৃতিকাতর করে সংগীত প্রেমীদের। স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ায় পারিবারিক বন্ধু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনগীতির তালিম নেন। পরে খোদাবক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, ইয়াছিন সাঁই, করিম সাঁইসহ আরও অনেকের কাছে লালনের গান শিখে তিনি আত্মনিয়োগ করেন লালনসঙ্গীতে।
 
৫৫ বছরের সঙ্গীত জীবনে লালন সঙ্গীতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব এক ঘরানা। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ও বাড়ির কাছে আরশিনগরসহ বহু জনপ্রিয় লালনগীতি তার কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। শ্রোতারা ভালোবেসে তাকে ‘লালনকন্যা’ উপাধি দিয়েছিলেন।

ফরিদা পারভীন শুধু দেশে নয়, বিশ্ব দরবারেও ছড়িয়ে দিয়েছেন লালনের বাণী। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে গেয়েছেন লালনের গান। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩, ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য), এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ ফুকুওয়াকা পুরস্কার (২০০৮)।

ব্যক্তিগত জীবনে ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার ও শিল্পী আবু জাফর। সেই সংসারে তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে- জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। পরে তিনি বাঁশি শিল্পী গাজী আবদুল হাকিমকে বিয়ে করেন।

স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় পৌর গোরস্থানের খাদেম নুরু বলেন, শিল্পী ফরিদা পারভীনের বাবা কুষ্টিয়া হাসপাতালে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ছোটবেলায় তিনি কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠেন। আমরা একই এলাকার মানুষ ছিলাম। ছোটবেলায় আমরা ফরিদা পারভীনের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। আমরা সমবয়সি হওয়ায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। বড় হওয়ার পরে তিনি কুষ্টিয়ার বাইরে থাকেন। এজন্য যোগাযোগ ছিল না। তবে দেখা হলে আমাদের কথা হতো। 

প্রসঙ্গত লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here