ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে কি হবে?

0
ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে কি হবে?

হরমুজ প্রণালী, পারস্য উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত নৌপথ। এই সরু জলপথটি বিশ্বের ব্যস্ততম তেল শিপিং চ্যানেল। যার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ শতাংশ বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস শিপিং করা হয়। সম্প্রতি, পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বেড়েছে।

হরমুজ প্রণালী কোথায় এবং এর গুরুত্ব কী?
হরমুজ প্রণালী ইরানের উত্তরে এবং ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দক্ষিণে অবস্থিত। প্রবেশ ও প্রস্থান মুখে এর প্রস্থ প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল), এবং সবচেয়ে সরু অংশে এটি প্রায় ৩৩ কিলোমিটার চওড়া। এটি বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল ট্যাঙ্কারগুলির জন্য যথেষ্ট গভীর এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলি (যেমন ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত) এবং তাদের গ্রাহকরা এটি ব্যবহার করে থাকে।

মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের অনুমান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল হরমুজ প্রণালীর মধ্য দিয়ে গেছে, যার বার্ষিক মূল্য প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এই তেল শুধুমাত্র ইরান থেকে নয় বরং ইরাক, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ থেকেও আসে।

প্রণালী বন্ধ হলে কী প্রভাব পড়বে?
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাহত হবে। তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। যা চীন, ভারত এবং জাপানের মতো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলিকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করবে। কারণ তারা এই প্রণালী দিয়ে আসা অপরিশোধিত তেলের শীর্ষ আমদানিকারক।

কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বদর আল-সাইফ বিবিসি নিউজআওয়ারকে বলেছেন, প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্ব বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়বে, কারণ তেলের দাম বেড়ে যাবে এবং শেয়ারবাজার খুব স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এটি উপসাগরীয় দেশগুলির অর্থনীতিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা জ্বালানি রপ্তানির উপর বেশি পরিমাণ নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরব প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে এই প্রণালীর মাধ্যমে, যা অন্য যে কোনও প্রতিবেশী দেশের চেয়ে বেশি।

এশিয়াও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০২২ সালে, হরমুজ প্রণালী থেকে আসা অপরিশোধিত তেল এবং কনডেনসেটের প্রায় ৮২% এশিয়ার দেশগুলির উদ্দেশ্যে ছিল। চীন একাই ইরানের মোট তেল রপ্তানির প্রায় ৯০% ক্রয় করে। এই সরবরাহ ব্যাহত হলে চীনে জ্বালানি ও উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, যা বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের কাছে উচ্চ মূল্যের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলিও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে, কারণ তাদের বেশিরভাগ তেল ও গ্যাস আমদানি এই প্রণালীর উপর নির্ভরশীল।

ইরান কিভাবে প্রণালী বন্ধ করতে পারে?
জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, দেশগুলি তাদের উপকূলরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (১৩.৮ মাইল) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। এর অর্থ হল, হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশে এর শিপিং লেনগুলি সম্পূর্ণভাবে ইরান এবং ওমানের আঞ্চলিক জলসীমার মধ্যে পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইরান প্রতি মাসে প্রায় ৩,০০০ জাহাজ চলাচলকারী এই প্রণালী বন্ধ করার চেষ্টা করে, তবে সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির মধ্যে একটি হল দ্রুত আক্রমণকারী নৌকা এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে মাইন স্থাপন করা। ইরানের নিয়মিত নৌবাহিনী এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের নৌবাহিনী বিদেশি যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ চালাতে পারে। তবে, বড় সামরিক জাহাজ মার্কিন বিমান হামলার সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে ইরান সাময়িকভাবে প্রণালী বন্ধ করতে সক্ষম হলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সামরিক উপায়ে দ্রুত সামুদ্রিক চলাচল পুনরায় শুরু করতে পারবে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতি ট্যাঙ্কারগুলিকে উপসাগরের মধ্য দিয়ে সামরিক কনভয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৃহত্তম নৌ কনভয় অভিযান ছিল।

ইরান কি সত্যিই প্রণালী বন্ধ করবে?
ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হাতে রয়েছে। যদিও ইরান অতীতের সংঘাতগুলিতে বারবার এই জলপথ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, তবে তারা কখনোই তা বাস্তবায়ন করেনি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা অর্থনৈতিক আত্মহত্যার শামিল হবে এবং চীনের প্রতি তেহরানের মিত্র হিসাবে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও চীন এখনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি, বেইজিং তেলের দাম বৃদ্ধি বা শিপিং রুটে কোনও বাধা পছন্দ করবে না এবং ইরানকে এই পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে তার কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করতে পারে।

জ্বালানি বিশ্লেষক বন্দনা হরি বলেছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে ইরানের পাওয়ার কিছুই নেই এবং হারানোর অনেক কিছু আছে। তিনি মনে করেন, ইরান তার তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের শত্রুতে পরিণত করবে এবং প্রণালীতে চলাচল ব্যাহত করে তার প্রধান বাজার চীনের ক্রোধের শিকার হবে।

বিকল্প রুট কি অবরোধের প্রভাব কমাতে পারে?
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার ক্রমাগত হুমকির কারণে, উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলি বছরের পর বছর ধরে বিকল্প রপ্তানি রুট তৈরি করেছে। সৌদি আরব তার ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন সক্রিয় করেছে, যা প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহনে সক্ষম। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের অভ্যন্তরীণ তেলক্ষেত্রগুলিকে ফুজাইরাহ বন্দরের সাথে একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে, যার দৈনিক ক্ষমতা ১৫ লাখ ব্যারেল।

সূত্র: বিবিসি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here